বাংলাদেশের রাজধানী, বিভাগীয় শহর, জেলা সদর কিংবা উপশহরে সর্বমোট ৪০ থেকে ৬০ লক্ষ ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা প্রতিদিন রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রিক্সা গুলো তুলনামূলক ভাবে প্রচলিত রিক্সার চেয়ে দ্রুতগতির জন্য শহরের যাত্রীদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
যাত্রীরা এখন প্রচলিত রিক্সার পরিবর্তে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাতে চড়তেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অপরপক্ষে, চালকরা এই রিক্সা চালাতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারন, এটা চালাতে তাদের খুব কম কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। ফলে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাংলাদেশের বাজারে ব্যাটারি চালিত এসকল অটোরিক্সার একটা অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ব্যাটারি চালিত এসকল অটোরিকশার বিরুদ্ধে দুর্বল ব্রেকিং সিস্টেম ও সিগনাল লাইট না থাকাসহ বেশ কিছু নিরাপত্তা ঝুঁকি’র অভিযোগ রয়েছে।
নিরাপত্তা ঝুঁকি সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (বিইপিআরসি) এর অর্থায়নে একটি গবেষণা প্রকল্পে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের একটি দল রিকশার একটি নকশা তৈরি করেছেন। তারা বলছেন, নতুন নকশার এই রিকশা হবে প্রচলিত অটোরিকশার চেয়ে অনেক নিরাপদ। যদিও এটি তৈরিতে বর্তমান ব্যাটারিচালিত রিকশার কাছাকাছি খরচ পড়বে।
এদিকে ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর ও উত্তর) কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা নতুন নকশা বা মডেলের এই রিকশা ঢাকার রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দেবে। পুরোনো মডেলের অটোরিকশা পর্যায়ক্রমে সড়ক থেকে তুলে নেওয়া হবে।
সারাদেশের রাজপথে এখন দুই ধরনের রিকশা চলাচল করে—পায়ে চালিত বা প্যাডেল রিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা । গত কয়েক বছরে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। নিবন্ধনহীন এসব রিকশা চালায় প্রশিক্ষণ বিহিন চালকেরা। আবার, এগুলোর গতি সাধারণ রিকশার চেয়ে বেশি। অথচ, এগুলোতে মানসম্পন্ন ব্রেক সিস্টেম ও ইন্ডিকেটর লাইটসহ কিছু প্রয়োজনীয় লাইট নাই। ফলে, এটার নিরাপত্তা দুর্বল।
নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে সারা দেশে সকল রাস্তায় ঝুঁকিপূর্ণ এই বাহনের চলাচল বন্ধের উদ্যোগ মাঝে মধ্যেই নেওয়া হলেও এদেরকে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবী করছে যে, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অটোরিকশা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। তুলনামূলক বেশী গতির এই রিকশার সংখ্যা (৪০ থেকে ৬০ লক্ষ), অল্প জ্বালানি খরচ (দৈনিক মাত্র ৩০-৩৫ টাকা) এবং যাত্রীদের পছন্দের কারণে এই বাহনকে বন্ধ করার সুযোগ নাই। বরং, বৈজ্ঞানিক ভাবে উন্নতমান সম্পন্ন করে তৈরি করা অটো রিকশাই হতে পারে প্রকৃত সমাধান।
কী থাকছে বুয়েটের নকশা করা রিকশায়
নতুন রিকশার নকশা করেছে বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. এহসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের গবেষক দল। বুয়েটের দলে আরও ছিলেন বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এ সালাম আকন্দ ও মো. আমান উদ্দীন, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক মো. জিয়াউর রহমান খান এবং গবেষণা প্রকৌশলী হিসেবে ছিলেন মো. আসাদুজ্জামান ও আবদুল আজিজ ভুঁইয়া। গবেষণা প্রকল্পটির অর্থায়ন করে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (বিইপিআরসি)।
বুয়েটের এই দলটি প্রচলিত অটোরিকশায় ১৬টি বৈশিষ্ট্য যোগ করে একটা নতুন মডেল দাঁড় করিয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা দেশে প্রচলিত ১২ ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশার নিরাপত্তা ত্রুটিগুলোকে বিবেচনায় নিয়েছেন।
আকারঃ
বুয়েটের দলটির প্রধান অধ্যাপক ড. এহসান জানান, ৩.২ মিটার দৈর্ঘ্য, ১.৫ মিটার প্রস্থ এবং ২.১ মিটার উচ্চতার এই রিকশার আকার হবে এখনকার রিকশার মতোই। রিকশাটি ৩২৫ থেকে ৪২৫ কেজি পর্যন্ত ওজন সহজেই বহন করতে পারবে। ফলে দুজন যাত্রী নিয়ে চালক সহজেই রিকশাটি চালাতে পারবেন।
উন্নতমানের ব্রেকঃ
নতুন রিকশার তিনটি চাকায় ‘হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক’ ও বিকল্প ‘পার্কিং ব্রেক’ সংযোজন করার মাধ্যমে এর ব্রেকিং ব্যবস্থা এখনকার চেয়ে অনেক উন্নত করা হয়েছে। ফলে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
‘লুকিং গ্লাস’ ও ‘ইন্ডিকেটর’ লাইটঃ
রিকশায় ‘লুকিং গ্লাস’ না থাকায় রিকশাচালককে বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখতে হয় কোনো যান আসছে কি না। রিকশায় ‘ইন্ডিকেটর’ লাইটও থাকে না। ফলে রিকশা ডানে অথবা বাঁয়ে মোড় নিলে পেছনের যানবাহনের চালকেরা তা বুঝতে পারেন না, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে। নতুন রিকশায় ‘লুকিং গ্লাস’ ও ‘ইন্ডিকেটর’ রাখা হয়েছে।
ছাউনি ও উইন্ডশিল্ডঃ
নতুন রিকশায় ছাউনি ও কাচের ‘উইন্ডশিল্ড’ থাকবে। ফলে বৃষ্টিতে চালক ও যাত্রীদের ভিজতে হবে না।
হেডলাইটঃ
নতুন রিকশায় কাঠামোর সঙ্গে হেডলাইট স্থায়ীভাবে যুক্ত করা হয়েছে, যাতে রাস্তার দৃষ্টিসীমা ঠিক থাকে। নতুন হেডলাইটে ‘হাই বিম’, ‘লো বিম’ ও ‘ডিআরএল’ (ডে টাইম রানিং ল্যাম্প) যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এই বাতি চালককে সড়কে চলাচলের সময় দেখতে এবং রিকশাটিকে অন্য যানবাহনের চালকের দৃষ্টিগোচর করতে সহায়তা করবে।
এই রিকশার গতি কেমন হবে
নতুন রিকশায় সর্বোচ্চ গতি ওঠানো যাবে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। এর তিনটি চাকায় ‘হাইড্রোলিক ব্রেক’ ব্যবহার করার কারণে রিকশাটি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ফলে, এটা চালানো নিরাপদ বলে জানান অধ্যাপক এহসান।
রিকশা তৈরি করতে খরচ কেমন হবে
রিকশা তৈরির নানা রকম উপাদান, সরকারি ট্যাক্স, শ্রমিকদের বেতন, এবং বিশেষ করে ব্যাটারির উচ্চমূল্যের কারণে আমাদের গুডহোপ মোটরস এ নতুন নকশার এই রিকশাটি ১৪০,০০০ থেকে ১৫০,০০০ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। ‘গুডহোপ মোটরস’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ তরিকুল ইসলাম বলেন, রিকশাটির জন্য উপযুক্ত দুই ধরনের ব্যাটারি রয়েছে, যেগুলোর মুল্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। বাকি খরচ হবে কাঠামো ও অন্যান্য এক্সেসরিজ এর ক্ষেত্রে।
এর ব্যাটারি একবার চার্জ দিলে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরত্ব যেতে পারবে।
কবে থেকে চালু
বুয়েটের দলের করা রিকশা রাস্তায় নামাতে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিকশার চালকের জন্য লাইসেন্স ও রিকশার নিবন্ধনের (রেজিস্ট্রেশন) ব্যবস্থা থাকবে। আমরা খুব দ্রুতই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রিকশাচালকেরা আবেদন করলে আমরা তাদের নম্বর প্লেট দেব।’
মোহাম্মদ এজাজ আরও বলেন, সরকার নির্ধারণ করে দেবে কোন কোন এলাকায় রিকশা চলতে পারবে। পুরো ঢাকা শহর ঘোরার অনুমতি দেওয়া হবে না। রিকশাভাড়াও সরকার নির্ধারণ করে দেবে।বর্তমানে চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তর সিটির প্রশাসক বলেন, ‘আমরা খুব ধীর প্রক্রিয়ায় এগুলোকে সরিয়ে ফেলব।